কেশ কীর্তন
–সুমিতা দাশগুপ্ত
সে ছুৃটছিলো, ছুটতে ছুটতে বে-দম হয়ে যাবার উপক্রম। দরদরিয়ে ঘাম ঝরছে, গলা শুকিয়ে কাঠ, কয়েক ঢোক জল খেতে পারলে ভালো হ’তো, কিন্তু এখন সে উপায় নেই। এক মুহূর্তের ব্যবধানও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সামনে দিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে যাচ্ছে, একখানা ভ্যানগাড়ি, নিজেকে প্রায় ছুঁড়ে দিয়েছিলো তার উপরে, কিন্তু হায় শেষ রক্ষা হলো না। চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টানে তাকে টেনে নামিয়ে নিলেন বটুক স্যার, তারপর রাস্তার উপর দাঁড় করিয়েই আচ্ছা করে গোটা কতক উত্তম মধ্যম দিয়ে , তার বড়ো সাধের চুলের টেরিখানা বাগিয়ে ধরে কাঁচি দিয়ে কচাৎ—
আঁ আঁ করে চিৎকার করতে করতে ঘুম ভেঙে গেল করঞ্জাক্ষবাবুর। হাঁফাতে হাঁফাতে সটান উঠে বসলেন বিছানায়।
নিজের অজান্তেই হাত চলে গেল মাথায়, হায় কোথায় সেই ঘন চুলের গোছা, টাকের উপরে গোটাকতক চুল ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ঝোপঝাড়ের মতো খাড়া হয়ে আছে।
নাইট ল্যাম্পের মৃদু আলোয় ঘরের সবকিছু দৃশ্যমান। পাশে শোয়া গিন্নি একবার চোখ মেলে চেয়েই ব্যাপারখানা বুঝে নিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলেন– “মরণ”,
তারপরই আবার পাশ ফিরে শুলেন, নাক ডাকতে লাগলো তাঁর।
পাশের টিপয়ে রাখা জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে অনেকটা জল খেয়ে, বড়োসড়ো একখানা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এখন মধ্যরাত,অগত্যাই আবার শুয়ে পড়তে হলো।
মনটা এই বয়সেও উথাল পাথাল, কেন যে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে বারে বারে ফিরে ফিরে আসে স্বপ্নটা! মনের অবদমিত বাসনা আজও পিছু ছাড়লো না!
বিছানায় শুয়ে ঘুম আসে না, কেবলই এপাশ ওপাশ করতে করতে স্কুলজীবনে ফিরে যাচ্ছিলেন তিনি।
তখন ক্লাস এইট-নাইন, দুপুরে স্কুল পালিয়ে ম্যাটিনি শো, ধীরে ধীরে রপ্ত করে ফেলছেন তাঁদের ক্লাশের কয়েকজন। না পালিয়ে উপায়ই বা কী। চকবাজারের নতুন সিনেমা হলে দেবানন্দের নতুন নতুন সিনেমা আসে। দেবানন্দ তখন তাঁদের আইডল, কী তাঁর চেহারা, কী কথাবার্তা বলার স্টাইল, আর ঘন একমাথা চুলের দুর্ধর্ষ টেরিখানা!! ওফফ্… ঐ রকম চুলের স্টাইল থাকলে যে কোন মেয়েকে ইমপ্রেস করা তো বাঁয়ে হাত কা খেল!!
শয়নে ,স্বপনে , জাগরণে তখন একটাই বাসনা, কীভাবে দেবানন্দ হওয়া যায়।একটু হেলে দাঁড়ানো, কথা বলার ধরন ,সবকিছুই আয়ত্ত করার আপ্রাণ প্রয়াস তাদের অনুক্ষণ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। প্রত্যেকের পকেটেই একখানা করে গুপ্ত চিরুনি লুক্কায়িত থাকে, সুযোগ পেলেই টুক করে একবারটি…
ব্যাপার স্যাপার বুঝতে বটুক স্যারের দেরি হলো না। কম ধুরন্ধর ছিলেন তিনি! সবসময় তক্কে তক্কে থাকতেন, হাতে চিরুনি দেখেছেন কি কেড়ে নিয়ে একখানা বিরাশি সিকদার চপেটাঘাত। উঃ ভাবলে এখনও গালটা টনটন করে ওঠে।সেই বটুক স্যার আজও পিছু ছাড়েননি।
স্কুলের পরে কলেজ, ভেবেছিলেন এখন আর কে কার তোয়াক্কা করে, ওয়েলকাম দেবানন্দ ওয়েলকাম টেরি, কিন্তু হায় ততদিনে এন্ট্রি নিয়ে নিয়েছেন অমিতাভ, রাজেশ খান্নারা। মেয়েরা আর টেরির দিকে ট্যারা চোখেও চায় না। প্রথমে ভেবেছিলেন নাইবা রইলো ফ্যাশন, তিনি আকৈশোর লালিত ইচ্ছেখানা ত্যাগ করবেন কেন! কালে দিনে বেশ জম্পেশ করে একখানা টেরি বাগিয়েও ছিলেন , ওমা তাই দেখে সকলে মিলে বিশেষ করে মেয়েরা সেকি প্যাঁক দেওয়া শুরু করে দিল!
তাও তিনি অকুতোভয় ছিলেন, একা কুম্ভ হয়ে রক্ষা করে যাবেন দেবানন্দের স্টাইল, এই ছিল তাঁর পণ। কিন্তু হায় ,এরপরই এলো চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্সখানা। বিয়ের পিঁড়িতে বসে শুভদৃষ্টির সময় নববধূর ভ্রুকুটি কুটিল দৃষ্টি আর কুঞ্চিত ওষ্ঠাধরের মানে বোঝা গেল ফুলশয্যার রাতে । আংটির সঙ্গে সঙ্গে টেরি বিসর্জনের প্রতিশ্রুতিখানাও দিয়ে দিতেই হলো, করঞ্জাক্ষবাবুকে।
ব্যাস্ টেরির কিসসা খতম। এখন স্বপ্নেই তার বাসা, তাতেও কি রেহাই মিলেছে! কোনোদিন বটুক স্যার, কোনও দিন মুখরা গিন্নি ছুটে এসে ঝুঁটি নেড়ে দিয়ে যায়।